১০৩ তম জন্মবার্ষিকীতে স্মরণে ইন্দিরা


নেতা, সবাই হতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে সবাই, কিন্তু কাজের মাধ্যমে মানুষের মনে চিরকালের মত জায়গা করতে পারে কয়জন!

মহান হতে, নজির সৃষ্টি করতে সাহসের প্রয়োজন, উনার সাহসের কোন তোলনা নেই, উনি একটি দেশকে স্বাধীন করিয়ে ছিলেন,

কমলা হারিস ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা উপরাষ্ট্রপতি হন। ইন্দিরা জি'র জন্মবার্ষিকীতে আজ আমাদের বুঝতে হবে যে, ভারতের জনগণ আজ থেকে ৫০ বছর আগে একজন মহিলা কে অর্থাৎ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে তাদের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেছে নিয়েছিলন।

ইন্দিরা জি'র সাহস এবং শক্তি সর্বদা বিশ্বজুড়ে মহিলাদের অনুপ্রাণিত করবে।

ভারতের স্রাষ্ট ও একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, অনেক সমস্যা, অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে দেশের জন্য, দেশের গরিবের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যান। উনার নেতৃত্ব দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী ছিল, ওনি "গরীবি হাটাও" এর স্লোগান দিয়েছিলেন, এবং জাতির স্বার্থে কাজ করে গেছেন।

উনার জন্ম ১৯ নভেম্বর, ১৯১৭ এলাহাবাদে, সময়টা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের, বাল্যকালে থেকেই তিনি তার পিতা পন্ডিত নেহরুর স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখে বড় হয়ে উঠেন।

বাল্যকালে তার উপর গান্ধীজি'র অসহযোগ আন্দোলনের খুব প্রভাব পড়েছিল। চারিদিকে তখন মানুষ অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে আগুনে বিদেশি দ্রব্যাদির আহুতি দিচ্ছে, ইন্দিরা ও তাই দেখেছেন চারিদিকে।

দেশজুড়ে তখন অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব তুঙ্গে একদিন প্যারিস থেকে ইন্দিরার এক আন্টি এলেন উনাদের বাড়িতে আশার সময় ইন্দিরার জন্য অনেক নতুন নতুন জামা-কাপড়, পুতুল নিয়ে এসেছিলেন, ইন্দিরা তখন খুবই ছোট তিনি তখন পুতুল নিয়ে খেলতে খুবই ভালোবাসতেন, তার পুতুলের খুবই ভাল সংগ্রহ ছিল, পুতুলি ছিল তার প্রিয় বন্ধু, কিন্তু তার আন্টি তাকে ডেকে এই সব জিনিস দিলে তিনি বলেন না আমার চাইনা এই সব বিদেশি জিনিস, যদি আমি বিদেশি জিনিস ব্যবহার করি তাইলে দেশ কিভাবে স্বাধীন হবে, আমি দেশের স্বাধীনতা চাই, কারন লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন এটাই দাবি করছেন, এবং এটা তাদের জন্য স্বাধীনতা যারা গরিব, বঞ্চিত, শোষিত, ছোট বয়স থেকেই এই রকম ছিল ওনার চরিত্র, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো উন্নত হতে লাগলো।

ইন্দিরা গান্ধী তার মা কমলা নেহরুর মৃত্যুর পর পড়তে চলে যান "Oxford University" তে, তখন থেকে তিনি জরিত হয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে, "Spanish Revolution" এর সময় ও তিনি সেখানে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার পরীক্ষার তারিখ এগিয়ে এসেছিল বলে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু তাকে সেখাতে যাওয়ার অনুমতি দেননি, ইন্দিরা পন্ডিত নেহরু কে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি রাজি হননি।

১৯৪১ ইন্দিরা যখন পড়া শেষ করে দেশে ফিরেন তখন দেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহ ছিল, ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু হচ্ছিল, সমগ্ৰ বিশ্বজুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়, খুবই খারাপ পরিস্থিতি ছিল ওনার পিতা পান্ডির নেহরু সহ জাতীয় কংগ্রেসের সকল বড় বড় নেতা তখন জেলে ছিলেন।

একবার কি হয়েছিল ১৯৪৭ এর দাঙ্গার সময় ইন্দিরা গান্ধী তার গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন, হটাৎ তিনি দেখিতে পান একজন তার গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন তার ঠিক পিছে তাকে মারার জন্য আরো ২০০ লোক দৌড়াচ্ছেন, তখন তিনি গাড়ি থেকে নেমে সেই লোকটিকে ধরে তার সামনে দাঁড়িয়ে গেলে, তাদের লিডার সামনে এসে বলেন, সরেজাও নাইলে মেরে ফেলব, তখন ইন্দিরা গান্ধী বলেন "মেরে ফেল, এই লোকটিকে মারতে হলে আগে আমাকে মারতে হবে, ইনি তোমাদের কি ক্ষতি করেছেন? ইনি তোমাদের কোন ক্ষতি করেন নি, তখন সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধী কে মেরে ফেলার অনেক ধমকি দেওয়া হয় কিন্তু তিনি সরে যান নি, সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারা চলে গেল ইন্দিরা সেই ব্যাক্তিকে ডেকে বলেন ভয় পেওনা সাহস দেখিয়ে সমস্যার সঙ্গে লড়াই করো" এটা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিত্ব।

দক্ষিণ ভারতেও তখন অস্পৃশ্যতার খুব প্রভাব, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তা মানতেন না, ওনার কাছে সবাই সমান ছিল তাই তিনি সব সময় বলতেন লাইনে থাকা সর্বশেষ ব্যাক্তিকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেওয়া উচিত তবেই দেশ উন্নত হবে।

তখন ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে নেমে পড়েছিলেন, তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অধীনে কাজ করতে শুরু করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে জড়িয়ে পড়ার ফলে পরবর্তী সময়ে তাকে গ্রেপ্তার ও করা হয়।

জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর যখন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হন তখন ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রী হতে চাননি কিন্তু তার সহগামিরা তাকে জোরকরেন মন্ত্রী হতে, নেহরুর মৃত্যুর পর ইন্দিরা রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেবার সম্পূর্ণ সিধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী অনেক বুঝিয়ে ইন্দিরা গান্ধী কে তার ক্যাবিনেটের সূচনা প্রসারণ মন্ত্রী করেন।

১৯৪৭ এ যখন সারা দেশে দাঙ্গা লেগেছিল তখন মহাত্মা গান্ধী ইন্দিরা গান্ধী কে ডেকে বলেন কিছু একটা কর সারা দেশে ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে, তখন ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির একটি এলাকায় যান সেখানকার মানুষ খুবই ভয়ে ছিলেন, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে সেখানে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করেন, কিন্তু প্রথম যখন ইন্দিরা গান্ধী সেখানে যান সেখানকার পরিস্থিতি দেখে তার চোখ দিয়ে জল এসে যায়।

সেই সময় ইন্দিরা গান্ধী কে মেরেফেলার অনেক ধমকি ও দেওয়া হয়, নেহরু কে ও অনেকে তার মেয়েকে মেরে ফেলা হবে বলে ধমকি দেওয়া হয়, তখন পন্ডিত নেহরু ইন্দিরা কে বলেন তোমি বাড়িতে থাক এই সব আমরা সামলে নেব, তখন ইন্দিরা তার পিতাকে জবাব দেন দেশের জন্য যদি আমার প্রাণ ও যায় তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই।

ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন পরিবেশপ্রেমী, তিনি পশুপাখিদের খুবই ভালোবাসতেন, তিনি মনে করতেন প্রকৃতি সবচেয়ে বড়, এর সঙ্গে খিলবার করা উচিত না।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলে পন্ডিত নেহরু দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলে সেই সময়টি ছিল ইন্দিরা গান্ধীর জন্য সবচেয়ে গর্বের মুহূর্ত। একই সঙ্গে সময়টি ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং কারণ দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ইংরেজ রা দেশ কে সম্পূর্ণ লোট-পাট করে চলে গেলেন।

তখন লক্ষ একটাই ছিল কি ভাবে দেশের উন্নতি করা যায়, ১৯৫৯ সালে ইন্দিরা গান্ধী কে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়, ১৯৫৯ এর পরবর্তী সময় থেকে দেশে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এমুন হয়ে উঠেছিল সবার শুধু চেয়ার চাই, ১৯৬৯ এ কংগ্রেসের প্রথম বিভাজন হয়, একটা সময় তো জোরতালের সরকার করার ও সময় এসেছিল ইন্দিরা গান্ধীর এই সব একদমই পছন্দ ছিলেন না কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর একটাই কথা ছিল দেশ সবার আগে।

সেই সময় প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের শুধু চেয়ারের চাহিদা ছিল, ইন্দিরা গান্ধী রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী শুধু একটা কথাই বলতেন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা পিছিয়ে কিছু একটা করতে হবে, দেশের উন্নতি সর্বপরি।

কিন্তু এতে কার কি যায় আসে, ধোনিদের এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথাই ছিল না, যত সমস্যা হত সবটাই হত দরিদ্রদের এবং ইন্দিরা গান্ধী এটা খুব ভালো করে বোঝতেন, এর জন্য তিনি পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গরীবি হাটাও এর স্লোগান দিয়েছিলেন।

তিনি দালাই লামা দ্বারা খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয়, চীনাদের প্রধান শত্রু, নেহরুর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, শাস্ত্রী জির আচমকায় মৃত্যু হলে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি কে কামরাজ সিদ্ধান্ত নেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন ইন্দিরা গান্ধী।

ইন্দিরা গান্ধীর জন্য এই প্রধানমন্ত্রীর তাজটি ছিল কাটায় ভরা কোন কিছুই তার জন্য সহজ ছিল না, তা সত্ত্বেও তিনি যে ভাবে সবকিছু গুছিয়ে ছিলেন তা সত্যই প্রশংসনীয়।

সেই সময় ইন্দিরা গান্ধী ছাড়া বাকি সকলেই ছিলেন চেয়ার প্রেমী নেতৃত্ব, তাই কে কামরাজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী কেই বেছে নিয়েছিলেন, কারণ একমাত্র ইন্দিরা গান্ধীই ছিলেন যে সম্পূর্ণ দেশের কথা ভাবছিলেন, দেশের জন্য কাজ করছিলেন।

তখন একের পর এক যুদ্ধের ফলে দেশের আর্থিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল, ইন্দিরা গান্ধীর চিন্তা ছিল কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা, এবং তিনি তা করেও ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সময়েই দেশে প্রথম সবুজ বিপ্লব হয়েছিল, তার সময়েই ভারত নিউক্লিয়ার শক্তি ও নিউক্লিয়ার স্টেট হয়েছিল।

ভারত তার সংষ্কৃতির জন্য সারা বিশ্বে বিখ্যাত ইন্দিরা গান্ধী ভারতের ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সংষ্কৃতি কে রক্ষা করার জন্য অনেক কাজ করে গেছেন।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জয় ও ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিত্বকে ফুটিতে তুলে, এই যুদ্ধের পর অটল বিহারী বাজপেয়ী ইন্দিরা কে মা দুর্গা বলেছিলেন।

ইন্দিরা গান্ধী সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন, তিনি সকল স্তরের মানুষে কে সমান চোখে দেখতেন, তিনি পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গরীব হাটাও এর স্লোগান দিয়েছিলেন এবং একে বাস্তবায়ন করতে তিনি প্রথম ২৬ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে "Privy purse" (১৯৪৭ এর পর থেকে সকল রাজা, মহারাজ, নবাব দের পরিবারের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল) কে বন্ধ করেন এবং সেই টাকা গরিবদের জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন।

এবং তিনি মহিলাদের সশক্তি করণের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন, তিনি নিজেও একজন সশক্ত মহিলা ছিলেন, তিনি বলেছিলেন মহিলাদের তাদের দক্ষতা প্রনাম করার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন মহিলারা কারুর থেকে পিছিয়ে না, মহিলাদের সঙ্গে কারুর কোন তোলনাই হয় না, একমাত্র মহিলারাই পারে এই সবকিছু সামাল দিতে।

অবশেষে ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪ তার নিজের দুই দেহরক্ষী দ্বারা তার হত্যা করা হয় তার নিজের বাড়িতে।

এত সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ ও ইন্দিরা গান্ধী ভারতের ১৩০ কোটি জনগণের মনে জায়গায় করে আছেন।

Shreyasi Laskar/ শ্রেয়শী লস্কর

Comments

Popular posts from this blog

Ami Hindu / আমি হিন্দু

জালিয়ানওয়ালাবাগ

যুক্তিতে ভক্তি