২১ মে – শহিদ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
প্রতিবছর ২১ মে তারিখটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক গভীর শোক ও জাতীয় বেদনার মুহূর্ত। এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, প্রগতিশীল চিন্তাধারার রূপকার ও আধুনিক ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা শহিদ শ্রী রাজীব গান্ধীকে। শুধু রাজীব গান্ধী জিই না এই দেশ গড়াই সম্পূর্ণ নেহরু-গান্ধী পরিবারের অবদান অপরিসীম, কিন্তু খুবই দুঃখজনক বিষয় রাজীব গান্ধী জির দূরদর্শিতা তার অবদান তার জীবন দশায় কেউ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। একজন সাহসী ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি যেভাবে ভারতকে প্রযুক্তি, শিক্ষা ও গণতন্ত্রের নতুন পথে পরিচালিত করেছিলেন, তা আজও দেশের উন্নয়নের ভিত্তি। আজ যারা ডিজিটাল ভারতের কথা বলছেন রাজীব গান্ধি জি যখন উনার শাসনকালে তথ্যপ্রযুক্তি, কম্পিউটার ও টেলিকমিউনিকেশন খাতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তখন কমিউনিস্ট সমেত সমস্ত বিরোধীরা এর বিরোধিতা করেছিলেন।
১৯৪৪ সালের ২০ আগস্ট, মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন রাজীব গান্ধী জি। তাঁর পিতামহ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং মা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তা সত্ত্বেও রাজনীতিতে তাঁর আগমন ছিল অনিচ্ছাকৃত। তিনি মূলত পেশাদার পাইলট হিসেবে নিজের স্বপ্নপূরণে নিরত ছিলেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে ভাই সঞ্জয় গান্ধীর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এবং ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ড তাঁকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
ক্ষমতার মসনদে বসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সর্বপ্রথম দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের শুরুতে রাজীব গান্ধী জি "Mr. Clean" নামে সুপরিচিত ছিলেন কারণ তিনি দুর্নীতিমুক্ত ও সৎ একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সেই সময় জনগণের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একপ্রকার ক্ষোভ ছিল এবং রাজনীতিতে সততার অভাব ছিল। রাজীব গান্ধী তরুণ, শিক্ষিত এবং প্রযুক্তি-বান্ধব একজন নেতা ছিলেন, যিনি প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও আধুনিকতা আনতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই ইমেজ এবং দুর্নীতিবিরোধী মনোভাবের জন্যই মিডিয়া ও জনগণ তাঁকে "Mr. Clean" বলে সম্বোধন করত।
তবে পরে বোফর্স কেলেঙ্কারির (Bofors Scandal) মতো কিছু বিতর্কিত ঘটনায় তাঁর এই ‘Mr. Clean’ ইমেজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
বোফর্স কেলেঙ্কারির সত্যতা এর সম্পর্কে বলাটা এই জন্য প্রয়োজন কারণ বর্তমানেও বোফর্স কেলেঙ্কারির নাম করে বিরোধীরা বিভিন্ন সময় আক্রমণ করে থাকেন।
১৯৮০-র দশকে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানি বোফোর্স থেকে কামান কেনার জন্য একটি চুক্তি করে। ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার বোফোর্স কোম্পানির সঙ্গে ₹১,৪৩৭ কোটি টাকার একটি চুক্তি করে, যার অধীনে ৪০০টি ১৫৫ মিমি হাউইৎজার কামান কেনা হয়। ১৯৮৭ সালে সুইডেনের রেডিওতে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে বলা হয় বোফোর্স কোম্পানি এই চুক্তি পাওয়ার জন্য ভারতের রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের প্রায় ₹৬৪ কোটি টাকার ঘুষ দিয়েছে। খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের রাজনীতিতে নতুন ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। ভিপি সিং সমেত একাধিক বিরোধী নেতা রাজীব গান্ধীর স্বচ্ছতার ছবিকে নষ্ট করতে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ সমেত প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। এই ঘটনার তদন্তের জন্য রাজীব গান্ধীজী ৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করেন, পার্লামেন্টে কমিটির তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই, সংসদের ভিতরে ও বাইরে ওঠা আওয়াজ এর ফলে রাজীব গান্ধী জি তার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থনে ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হন এবং উনি এই তদন্তের ভার সিবিআই এর হাতে তুলে দেন। বহু বছর তদন্ত চলার পর ২০০৪ সালে দিল্লি হাইকোর্ট প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় এবং ২০১১ সালে সিবিআই দিল্লি হাইকোর্ট কে জানান এই এই কেলেঙ্কারির কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি ফলে মামলাটি বন্ধ করার অনুরোধ করেন।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এই বহু চর্চিত বোফোর্স কোম্পানি থেকে কেনা কামান দিয়ে ভারতবর্ষ কারগিল যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল।
রাজীব গান্ধীজি তার শাসনকালে যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছিল তা এত স্বল্প সময়ে আলোচনা করা সম্ভব না তবে এর মধ্যে অন্যতম ছিল মহিলা ক্ষমতায়ন, পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থা চালু করা, নবোদয় বিদ্যালয়ের গঠন।
রাজীব গান্ধীর শাসনকাল (১৯৮৪-১৯৮৯) ছিল প্রযুক্তিনির্ভর, যুবনির্ভর ও উন্নয়ননির্ভর এক যুগের সূচনা। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে হলে তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং শিক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর নেতৃত্বেই ভারতে কম্পিউটার বিপ্লবের সূচনা হয়। তিনি টেলিকম খাতের সংস্কার করেন, যার ফলশ্রুতিতে আজকের ডিজিটাল ভারতের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
তিনি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পক্ষে ছিলেন। তাঁর সরকার ‘জনতা সরকারের’ ধারণাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথ্যের বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ গেছেন।
*নারী ক্ষমতায়নে অগ্রণী ভূমিকা*
শ্রী রাজীব গান্ধী নারীর ক্ষমতায়নকে সামাজিক উন্নয়নের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে দেখতেন। তাঁর শাসনকালে নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়াতে গৃহীত হয় একাধিক দূরদর্শী পদক্ষেপ। বিশেষ করে, পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থায় নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের প্রস্তাব ছিল এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। তাঁর উদ্যোগে প্রণীত সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নারীদের জন্য স্থানীয় স্বশাসন ব্যবস্থায় ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের বিধান কার্যকর হয় — যা ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে লক্ষ লক্ষ নারীর অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করে।
শুধু রাজনৈতিক অংশগ্রহণই নয়, রাজীব গান্ধীর সরকার নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আত্মনির্ভরতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতে তাঁর সংস্কার নারীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে, যার ফলে তাঁরা ধীরে ধীরে সমাজের মূলস্রোতে যুক্ত হতে সক্ষম হন।
*পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার পুনর্গঠন*
রাজীব গান্ধীর অন্যতম স্বপ্ন ছিল ভারতীয় গণতন্ত্রকে তৃণমূল পর্যায়ে সুদৃঢ় করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত গণতন্ত্র তখনই সম্ভব, যখন গ্রামীণ জনগণ প্রশাসনের অংশীদার হয়। এই দর্শনের ভিত্তিতে তিনি পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য ৬৪তম সংবিধান সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেন। যদিও বিলটি তখন পাস হয়নি, তাঁর প্রচেষ্টার পথ ধরেই ১৯৯২ সালে ৭৩তম সংশোধনী বিল পাস হয় এবং স্থানীয় স্বশাসন ব্যবস্থার নতুন যুগ শুরু হয়।
এই সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনস্তর বিশিষ্ট পঞ্চায়েতি শাসনব্যবস্থা—গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ। এতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়, যা গ্রামীণ জনগণের কাছে উন্নয়নের সুযোগ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
নবোদয় বিদ্যালয় গঠনে রাজীব গান্ধীজির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রগতিশীল ও দেশের ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশক। তিনি বিশ্বাস করতেন গ্রামীণ মেধাকে সুযোগ দিলে তারা শহরের সমান প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারে। নবোদয় বিদ্যালয় গুণগত ও বিনামূল্যে শিক্ষার মাধ্যমে দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ দেয়। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা মিলেমিশে পড়ে, যা জাতীয় ঐক্য ও সংহতির মূলে কাজ করে। বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং মানবিক মূল্যবোধে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু কর্মজীবনের জন্য নয়, সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠাই ছিল রাজীব গান্ধীর মূল লক্ষ্যমাত্রা।
নবোদয় বিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি স্কুল নয়, বরং রাজীব গান্ধীর স্বপ্নের প্রতিফলন— একটি সমতাভিত্তিক, শিক্ষিত, ও ঐক্যবদ্ধ ভারতের প্রতিচ্ছবি।
পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কায় বেড়ে উঠে উগ্রবাদ সমস্যা যার প্রভাব পড়ছিল দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে। শ্রীলঙ্কায় বেড়ে ওঠা উগ্রবাদী সমস্যা সমাধানে ও শান্তির প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন রাজীব গান্ধী জি জার ফলশ্রুতিতে ১৯৯১ সালের ২১ মে, নির্বাচনী প্রচারের সময় তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে এলটিটিই-র আত্মঘাতী হামলায় রাজীব গান্ধী শহিদ হন। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড কেবল একজন নেতা নয়, বরং একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিগন্তকে ছিন্ন করে দেয়।
তবু, তাঁর আদর্শ, সংস্কার ও স্বপ্ন আজও বেঁচে আছে ভারতের প্রতিটি শিক্ষার্থী, নারীনেত্রী, বিজ্ঞানী, ও যুব সমাজের মধ্যে।
শহিদ রাজীব গান্ধী ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি সাহসের সঙ্গে নতুন পথ খুঁজেছিলেন, যুবসমাজকে অগ্রাধিকারে রেখেছিলেন এবং এক আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে তথ্য, শিক্ষা ও সমতার ভিত্তিতে।
আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের কর্তব্য— তাঁর স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। কারণ একজন নেতা চলে যেতে পারেন, কিন্তু একজন স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্ন বেঁচে থাকে জাতির হৃদয়ে।
*"রাজীব গান্ধী নেই, কিন্তু তাঁর চিন্তা ও কৃতিত্ব আজও ভারতবর্ষের প্রগতির প্রেরণা।"*
শ্রেয়শী লস্কর ✍🏻
Comments
Post a Comment